ভণিতা

আমরা, যারা নব্বইয়ের কিশোর/কিশোরী, বাংলা গানের ইতিহাসের অতুলনীয় এক অধ্যায় যাপনের গর্ব শেষমেষ থেকেই গেল আমাদের শিরায়। যে প্রবহমানতার অংশ ছিলাম আমরাও কোনওভাবে, সেই অভিজ্ঞতার কিছু স্মৃতিচিত্র, কিছু প্রত্যক্ষদর্শন, যা হয়ত এমনকি বিস্মৃতিসম্ভাবনায় ঝাপসাও ক্রমশঃ, চাইছি কোথাও সংরক্ষিত রেখে যেতে। ভবিষ্যতের জন্য।

এ কথা তো বহুশ্রুত, নব্বইয়ে বাংলা গান যে চমকপ্রদ পালাবদলের মধ্যে দিয়ে গিয়েছিল তার প্রস্তুতিপর্ব অন্তত তিন দশকের। সত্তরের উত্তাল রাজনৈতিক টানাপোড়েনের সময় বাংলা সাহিত্য, কবিতা, ছায়াচিত্র ও শিল্প জগতে যেভাবে পুনর্গঠনচেষ্টা চলেছিল, গানের পৃথিবী তার ছোঁয়াচ একেবারে এড়িয়ে যেতে পারে নি। অন্তত গৌতম চট্টোপাধ্যায় ও মহীনের ঘোড়াগুলি সে সাক্ষ্য দেয়। তবু, সিনেমাজগতের 'আর্টফিল্ম'-এর ফল্গু প্রতিম বাংলা অন্য ধারার গানের অবস্থানও ছিল শ্রোতা-অভিনিবেশের বিপ্রতীপেই। সে কারণেই তো, নাগরিক নামক গানের দলের জন্মের আট বছর পরেও সুমন চট্টোপাধ্যায় বস্তুত অশ্রুতই ছিলেন, তোমাকে চাই এর দ্বিজত্বের অপেক্ষায়।

তাই আমাদের দাবি, সমকালীন সমাজযাপনের প্রত্যয়চিহ্ন সমন্বিত বাংলা গানের সেই অন্তঃসলিলা, নব্বইয়ের দশকেই প্রকৃত প্রস্তাবে মূলধারার শ্রোতৃগোচরে এল। এবং তারপর, অন্তত দেড় দশক, বাংলা গানের বিশেষত্ব ও লক্ষণ - যুগচিহ্নধারন হয়ে উঠতে পেরেছিল। সমকালের থেকে মুখ ফিরিয়ে শুধুমাত্র চিরাচরিত অনুভূতি ও অভিব্যক্তির প্রকাশেই বাংলা গানের প্রসববাহুল্য সীমায়িত থাকল না। ভাষা, আঙ্গিক, যন্ত্রানুসঙ্গ সব মিলিয়ে বাংলা গানের অ্যাপ্রোচটাই বদলে গেল। এতদিন যাকে আধুনিক বাংলা গান বলা হচ্ছিল, তার থেকেও, বলা উচিত‌ একটা ডিপার্চারই যেন হয়ে গেল বাংলা গানের।


সুমন চট্টোপাধ্যয় (কবীর সুমন), নচিকেতা চক্রবর্তী, অঞ্জন দত্ত, শিলাজিৎ মজুমদার, মৌসুমী ভৌমিক, প্রতুল মুখোপাধ্যায়, কাজি কামাল নাসের, পল্লব কীর্তনিয়া, তপন সিনহা, রূপঙ্কর বাগচী, শমীক সিনহা, ঋতিকা সাহানে, লোপামুদ্রা মিত্র, শ্রীকান্ত আচার্য, অনুশ্রী-বিপুল, স্বপ্নাভ-সায়ন্তনী, ইত্যাদি যতজন সম্ভব কে নিয়ে আমরা একটা লম্বা লিস্ট তৈরি করেছি, যাঁরা এই নতুন ধারার গানের সৃষ্টিযজ্ঞে অংশ নিয়েছিলেন, অন্তত কিছুকাল। যাঁরা বহন করে চলেছেন অরুণেন্দু দাস, জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, রঞ্জন প্রসাদ, বিনয় চক্রবর্তীর প্রবহমানতা।

সেই একটা সময়, যখন একজন মানুষ তার গান লিখছেন, সুর দিচ্ছেন, গাইছেন, বাজাচ্ছেন, কখনও কেউ শুধুই লিখছেন, শুধুই সুর দিচ্ছেন, শুধুই গাইছেন। তাদের কেউ কেউ হয়তো শেষ অবধি অন্য ভাষার বা ভিন্নতর আঙ্গিকের গানেই অভিনিবেশ করেছেন। কেউ জীবিকার প্রয়োজনে সিনেমা সিরিয়ালে বাণিজ্যিক কাজ করেছেন নানাবিধ। তবু, আমাদের কাছে তা সেইসব অন্য পথের পথিকদেরই উদ্বর্তনের সাক্ষ্য, তাঁদেরই বিবর্তন।

অন্যদিকে একক গানের থেকে শুরু হচ্ছে গানের দল, বাংলা ব্যাণ্ড। মহীনের ঘোড়াগুলি, বেহালা চৌরাস্তা, নগর ফিলোমেল- এর পথ ধরে একে একে ক্যাকটাস, পরশপাথর, চন্দ্রবিন্দু, শহর, ভূমি, ফসিলস, অভিলাষা, ক্রস উইন্ডস, আগন্তুক- এক ঝাঁক নতুন ব্যান্ড। নতুন গান, নতুন সুর নিয়ে বিশাল বিশাল ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ল বাংলা গানের উঠোনে, অগুনতি, অসংখ্য। পাড়ায় পাড়ায় স্কুলে কলেজে কয়েকজন বন্ধু একজোট হলেই একটা বাংলা ব্যাণ্ড। এই সময়টার মধ্যে দিয়েও এসেছি আমরা নব্বইয়ের শেষে, সহস্রাব্দের সমীপে। সেই উন্মাদনা সেই সৃজনশীল পাগলামোর যতটুকু যা সম্ভব ধরা থাক এখানেই।

ইচ্ছা রইল গানের এই সব কারিগরদের সমস্ত গানের হিসেবনিকেশ, খোঁজ খবর এখানেই রাখার। এই দেড় দশকের বাংলা গানের সামগ্রিক একটা ইতিহাসের বিবরণ লিপিবদ্ধ রাখা যে কত কঠিন হবে তা আর নতুন করে বলার কিছু নেই। সহজবোধ্য, আমাদের দু-তিনজনের পক্ষে এই বিশাল ইতিহাসের ডকুমেন্টেশন, আর্কাইভিং আরো দুরূহ। তাই, সাহায্য চাইছি সেই সমস্ত মানুষের, বন্ধুদের, যারা এখনো কোনওভাবে কিছুটা অন্তত সেই সময়ের গান রেখেছেন নিজেদের কাছে। তাঁরা যদি সকলের সঙ্গে ভাগ করে নেন তাদের সংগ্রহ, তবেই সম্ভাবনা এক পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনার। আমাদের অঙ্গীকার: কৃতজ্ঞতা স্বীকারের, প্রত্যেকের যৎসামান্য সাহায্যটুকুরও।

যেগুলো আমরা করব বলে ভেবেছি এখানে :

১) ডিসকোগ্রাফি: যতজন সম্ভব এই গানের কারিগরদের সমস্ত সৃষ্টিসম্ভারের লিস্ট তৈরি করা।

২) লিরিকস: যতগুলো সম্ভব এই পর্যায়ের গানের সম্পূর্ন লিরিকস ডকুমেন্ট করা।

৩) আর্কাইভিং: এই সমস্ত গানের আর্কাইভিং করা যতদূর সম্ভব 320 KBPS MP3 ফরম্যাট এ, যথাযথ ট্যাগিং ও অ্যালবাম-আর্টের ডিটেলস সহ।

৪) হাইপারলিংকড ডেটাবেস: যাবতীয় রেফারেন্সিং হাইপারলিংকড রাখা যাতে কোনো গীতিকার, সুরকার, গায়ক বা সহশিল্পী বাদক দের নামে ক্লিক করে তাদের সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য পাওয়া যায়। তথ্য রাখা বিভিন্ন ক্যাসেট/সিডি কোম্পানিরও যারা পরিবেশক ছিলেন এই সব গানের।

৫) ইন্টারভিউ: যতজন সম্ভব এই সমস্ত শিল্পীদের ইন্টারভিউ রেকর্ড করা ও আর্কাইভে রাখা, যা এই সময়টা সম্পর্কে ঐতিহাসিক ও গবেষকদের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সংরক্ষন করবে।

৬) খোঁজখবর: খুঁজে বের করতে চাই এমন সব নাম এমন সব স্রষ্টা যাঁরা হয়তো এখন বিস্মৃতির অতলে কিংবা অবিলম্বে বিস্মৃত হয়ে পড়বেন। কিন্তু তারাও কোনো সময় এই নতুন বাংলা গান কিছু বানিয়েছিলেন এই নতুন উদ্দীপনায় অংশগ্রহণের উপলক্ষ্যে। তাঁদের দুষ্প্রাপ্য সিডি-ক্যাসেটের আর্কাইভিংও আমাদের উদ্দেশ্য।

৭) রেকর্ডিং: এমন প্রচুর গান আমরা জানি, যেগুলো হয়তো নানা প্রতিকূলতায় কোনওদিনও রেকর্ড করা হয় নি। অথচ অনুষ্ঠানে গাওয়া হয়েছে, মানুষে শুনেছেন, পছন্দ করেছেন। সেগুলো যদি আজ সম্ভব হয়, রেকর্ড করেও রাখতে চাই সকলের শোনার জন্যে।